ব্রিটিশদের বিনা পয়সায় চা পান করানোর ঘটনা এখন ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলেই চায়ের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় শুরু। আজ থেকে ১৫৮ বছর আগে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম চা বাগান তৈরি হয়। শুরু হয় বাণিজ্যিক চা উৎপাদন।
আজকের দিনের অপরিহার্য এই পানীয়কে ভারতবর্ষে ঢুকতে হয়েছিল অনেক বাধাবিঘ্ন ও ঝুটঝামেলা পার করে। ছোট ছোট দোকান খোলার জন্য নামমাত্র দামে, বাকিতে ও বিনা মূল্যে চা সরবরাহ করেছে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো। ব্রিটিশরা প্রথমেই বুঝেছিল, এখানে চা-চাষকে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে না, যদি বাঙালিদের কাছে চায়ের মর্ম পৌঁছে দেওয়া না হয়। ‘অসম চা কোম্পানি’ নামের প্রথম চা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজরা চা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞাপনে নামে। বিশেষজ্ঞ দিয়ে তখনই প্রথম বের করা হয় চা পানের বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা। চমক দেওয়া ভাষা দিয়ে তৈরি করা হয় নানামুখী প্রচারপত্র। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন—‘প্রাণশক্তি ও উৎসাহের উৎস এবং ম্যালেরিয়ানাশক—ভারতীয় চা। দরকার হলেই ভারতীয় চা ব্যবহার করে অচিরে শরীর-মন সতেজ করে তোলা যায়, এ যে কত বড় সান্ত্বনা, তা বলা যায় না। সারা দিনের কঠিন শারীরিক পরিশ্রম বা মাথার কাজের পর এক পেয়ালা ভালোভাবে তৈরি দেশি চা খেলেই শরীর সজীব ও মন প্রসন্ন হয়ে উঠবে। সত্যিই চা জাগ্রত জীবনীশক্তির আধার। সকালবেলা নিয়ম করে অন্তত দুই পেয়ালা ভালো দেশি চা রোজ পান করুন, জড়তা দূর হয়ে যাবে—সারা দিন শরীর মজবুত থাকবে, আবার দিনের শেষে দুই পেয়ালা চা পান করবেন—সারা দিনের খাটুনির পর মধুর বিশ্রামের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।’
চা মার্কেটিংয়ের জন্য বেছে নেওয়া হয় ট্রেন স্টেশনসহ বিভিন্ন লোকালয়। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, স্টিমার ঘাটসহ পাবলিক প্লেসে বিজ্ঞাপন ফলক লিখে প্রচার শুরু করে। সমাজে চা জনপ্রিয় করে তোলার জন্য শহর, বন্দর, নগর ও লোকালয় যেমন রেল স্টেশন কিংবা স্টিমারঘাটে টি-স্টল গড়ে তোলা হতো কম্পানিগুলোর উদ্যোগে। তা ছাড়া দর্শনীয় স্থানে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। সেসব বিজ্ঞাপনে চা পানের গুণকীর্তন করা হতো। যেমন-চা পানে শরীর সতেজ ও চাঙা হয়, আমাশয় ও প্লেগ রোগ সারে প্রভৃতি।
দেশ পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ ৩ সংখ্যায় (৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত) আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের একটি কলাম প্রকাশিত হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘চা-এর প্রচার ও দেশের সর্ব্বনাশ’। বেশ বড় আকারের প্রবন্ধে তিনি ব্রিটিশদের চা নিয়ে মাতামাতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘শীত-প্রধান দেশে চা-পানের কিছু প্রয়োজন থাকিতে পারে সত্য, কিন্তু আমাদের উষ্ণ দেশে উহার কোনই সার্থকতা নাই। সাহেবরা যখন চা পান করে, তখন তাহার সঙ্গে অনেক কিছু পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী পেটে পড়ে, কিন্তু কলিকাতা, বোম্বাই প্রভৃতি নগরের স্বল্প বেতনভুক্, শীর্ণ কেরাণী আহার্য্য ও পানীয়ের উভয়বিদ প্রয়োজনে চা পান দ্বারাই মিটাইয়া থাকেন। আপিসে আসিয়া ২/১ ঘণ্টা কাজে বসিতে না বসিতেই ইহারা চা-এর তৃষ্ণায় কাতর হন। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে চা পান করিয়া ইঁহারা ক্ষণিকের জন্য কিঞ্চিত আরাম ও উত্তেজনা এবং স্ফূর্তি অনুভব করেন। আবার সেই একঘেয়ে হুড়ভাঙ্গা খাটুনি—মধ্যে মধ্যে চা-এর পেয়ালায় চুমুক—ইহাই হইল কেরাণীর দৈনন্দিন জীবন। এই প্রকারে সারা দিনরাত প্রায় পাঁচ ছয় পেয়ালা চা। এই বদ অভ্যাসের পক্ষে তিনি এই যুক্তি দেখাইয়া থাকেন যে, উহাতে ক্ষুধা নষ্ট হয়, সুতরাং ব্যয়সাধ্য পুষ্টিকর আহার্য্যেও আর প্রয়োজন পড়ে না।’ চা নিয়ে ইংরেজদের বিজ্ঞাপনী ভাষার সমালোচনা করে তিনি আরেক জায়গায় বলেন, ‘অতিরঞ্জন, অতিভাষণ ও মিথ্যাভাষণ উক্ত প্রচারকার্য্যের মূলমন্ত্র। ইউরোপে চায়ের বাজার মন্দা যাইতেছে, তাই সেখানকার মন্দা এতদ্দেশে উশুল করিবার জন্য টী অ্যাসোসিয়েশন জনসাধারণের মুখে চা-এর বিষপাত্র তুলিয়া ধরিতে মরিয়া হইয়া লাগিয়াছেন। ৫/৬ কোটি ভুখারী, দারিদ্র্য ও উপবাস তাহাদের নিত্যসঙ্গী, পেট ভরিয়া আহার কাহাকে বলে জানে না, কিন্তু তাহাতে কি যায় আসে? অর্থলোলুপ স্বার্থান্বেষী ধনিক ও বণিক সমাজ স্বকার্যসাধনে কোন জীন উপায় বা চাতুরীর আশ্রয় লইতে কুণ্ঠিত হয় না। মিথ্যা প্ররোচনায় মুগ্ধ করিয়া হতভাগ্যদিগকে ঊর্ণনাভের জালে জড়িত করিতেই ইহাদের উৎসাহের কমতি নাই।’ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেন, ‘মুষ্টিমেয় নির্মম ধনিকের লালসা-বহ্নি, তাহাতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মাহুতি দিতেছে সাধারণ জনগণ।’ তৎকালীন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জন ফিসারের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘হুইস্কির বোতল কিংবা চায়ের পাত্র ইহাদের কোনটি যে অধিকতর মারাত্মক, তাহা নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন।’
সন্দেহ নেই, সেকালে ব্রিটিশের পণ্য প্রসারের জন্য অনেক ভারী চিন্তাশীল বাঙালির সহায়তা ছিল। সে সময় আধুনিক বিজ্ঞাপন ভাষার ব্যাপ্তি আজকের মতো ছিল না। এখন বিজ্ঞাপনের অনেক ধারাও চালু হয়েছে। অনেক দক্ষ কর্মীরা কাজ করছেন বিজ্ঞাপনে। এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্ডাস্ট্রি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ৮-১০টি বিজ্ঞাপনও বানাচ্ছে। বিজ্ঞাপনের কারণে জনসাধারণ উদ্দিষ্ট পণ্যটি পরিহার করে—এমন ঘটনাও আছে। কিন্তু ব্রিটিশদের সময়ে তৈরি করা চায়ের বিজ্ঞাপনের সেই আবেদন যেন আজও তরতাজা। আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আজ থেকে ৭৬ বছর আগে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেই সর্বনাশ হয়ে গেছে বহু আগে। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে বাংলাদেশ বছরে চা উৎপাদন করে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি। অষ্টম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আমাদের চা যায় ২৫টি দেশে। আর ওই বিজ্ঞাপনের গুণেই হোক আর যেভাবেই হোক, দেশে প্রতিবছর চা-পায়ীর সংখ্যা বাড়ছে ৬ শতাংশ হারে।
চা পানকারী প্রথম বাঙালি
ব্রিটিশদের বসতির আগে বাংলায় চা-পানের প্রচলন হয়নি। তবে চীনে চা-পানের ইতিহাস অনেক পুরোনো; বিশেষভাবে তিব্বতে। সেই তিব্বতেই সর্বপ্রথম বাঙালি হিসেবে চায়ে আপ্যয়িত হয়েছিলেন অতীশ দিপঙ্কর ১০১১ খ্রিস্টাব্দে। ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অতীশ দিপঙ্কর। জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি ১০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় গিয়েছিলেন সেখান থেকে ফেরার পথে বাংলা-বিহারের রাজা মহীপালের অনুরোধে ভারতের বিহার রাজ্যের বিক্রমশীলা বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকে নেপাল হয়ে তিনি তিব্বতে যান। সেখানে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। এখানেই তিনি প্রথম চা পান করেন।
0 টি মন্তব্য:
Post a Comment